দীপুর ১৮৫৭ (নব কলকাতা)

ফিরে দেখা

দীপুর মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি রয়ে গেছে লন্ডন ঘুরে আসার পর থেকে

ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পাথরের দেওয়াল, বিশাল চাঁদোয়া, কাঁচের ভেতরে সাজানো কোহিনূর। সবকিছুই জাঁকজমকপূর্ণ, কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা ঘিরে ধরছিল তাকে। অগণিত মানুষের কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও সে যেন কিছু একটা অনুভব করছিল, যা বাকিদের চোখ এড়িয়ে গেছে। টাওয়ার অব লন্ডনের সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল, “আমাদের এত কিছু ওরা নিল কীভাবে?”

কোহিনূরের হীরের আভা তখনো তার চোখে লেগে আছে, কিন্তু বুকের ভেতর যেন একটা ফাঁকা জায়গা। কীভাবে এত দূর থেকে এসে একদল শাসক একটা গোটা দেশের ইতিহাস বদলে দিল? কীভাবে তাদের হাতে গেল সেই রত্ন, যা একদিন ভারতীয় রাজাদের মুকুটে শোভা পেত?

আজ রাতেও সেই চিন্তা তাকে ছাড়ছে না। দীপু নিজের ঘরে বসে ইতিহাসের বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একেকটি অতীতের জানালা, যেখানে ভারতবর্ষের গৌরব আর সংগ্রামের গল্প লেখা রয়েছে।

কলকাতা একসময় ছিল ব্রিটিশ শাসনের প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকেই তারা পুরো ভারত নিয়ন্ত্রণ করত। শাসনযন্ত্রের প্রতিটি সুতো টানা হত এই শহর থেকে। “কিন্তু যদি…১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ যদি সফল হত? সব অন্যরকম হতো?”

তার চোখ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছে। বইয়ের খোলা পাতায় আঙুল রাখা, কিন্তু মন যেন অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে।একটা নতুন ইতিহাস, একটা অচেনা বাস্তবতার দরজা…

দীপু বইটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।

অন্য এক কলকাতা!

সে যেন শূন্যে ভাসছে। চারপাশটা আবছা, কেমন যেন এক রকম শূন্যতার অনুভূতি। হঠাৎ একটা প্রবল ধাক্কা! দীপু সজোরে এসে আছড়ে পড়ল পাথরের ফুটপাথে! রাস্তার পাথর ঠান্ডা, কিন্তু পুরোপুরি শুষ্ক নয়। যেন বৃষ্টি হয়ে শুকিয়ে গেছে, কিংবা দিনের উত্তাপ কমে আসছে। বাতাস ভারী, গরম ধুলোর কণা উড়ছে, যেন কোথাও আগুন জ্বলছে বা কিছু পোড়ানো হয়েছে। বাতাসে যেন বালির মতো কিছু মিশে আছে।

গাঢ় তেলের গন্ধ ভেসে এলো, সঙ্গে ধোঁয়ার এক অচেনা ঘ্রাণ। দূরে কোথাও একটা বিশাল যন্ত্র গমগম করে আওয়াজ করছে, যেন কোনো অজানা কারখানা চলছে। দীপু ধাক্কা সামলানোর আগেই মাটির স্পর্শ পেল। হাত দিয়ে রাস্তার ধুলো ছুঁলো, রঙ লালচে, যেন এই শহরের মাটিতে অন্য কিছু মিশে গেছে। একটা মুহূর্তের জন্য সে বিভ্রান্ত।

মাথা তুলে তাকাতেই চমকে উঠল — এটা তার চেনা কলকাতা নয়।

চারপাশটা একেবারে অদ্ভুত। ট্রামের লাইন নেই, রাস্তার ধারে অচেনা সব যানবাহন। বিশাল হাতির শোভাযাত্রা এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে এক বিশাল রথ, যার পেছন দিক থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। যেন কোনো স্টিম-চালিত বিশাল যান। রাস্তার দুপাশে উঁচু দালান, কিন্তু এগুলো ইউরোপীয় ধাঁচের নয়। এখানে মুঘল গম্বুজ, রাজপুত দুর্গের ব্যালকনি, মারাঠি মিনার — সব একসঙ্গে জুড়ে গেছে, যেন ইতিহাসের নানা সময় এক জায়গায় মিলেমিশে তৈরি হয়েছে এই শহর।

লোকজন রাস্তায় ব্যস্ত। পুরুষদের মাথায় পাগড়ি, কেউ গাঢ় রঙের কুর্তা পরে, আবার কেউ ভারী ধাতব বর্মের মতো কিছু পরেছে, কোমরে ঝুলছে খাপঢাকা তলোয়ার। মহিলারা গাঢ় রঙের শাড়ি পরে হাঁটছে, সঙ্গে ছোট ছোট রুপোর ঘুঙুর বাঁধা। কয়েকজন কাঁধে ধনুক নিয়ে এগোচ্ছে, তাদের পোশাক যুদ্ধের মতো — কিন্তু ব্রিটিশদের মতো নয়, বরং ভারতীয় রাজাদের সেনাদের মতো।

আকাশের দিকে তাকাতেই দীপু দেখতে পেল, একটা বিশাল পতাকা বাতাসে দুলছে। সোনালি রঙের বাঘ, যেন এক লাফে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। তার নিচে বড় বড় হরফে লেখা — “হিন্দুস্তান সম্রাজ্য — নব কলকাতা, ১৯০৭”। দীপুর শরীরের ভেতর শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। “হিন্দুস্তান সম্রাজ্য? নব কলকাতা?”

এটা কীভাবে সম্ভব? ১৯০৭ সাল তো ব্রিটিশ শাসনের সময়! তাহলে এই শহর কোথা থেকে এলো? সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যিই অন্য এক ইতিহাসের কলকাতায় এসে পড়েছে?

ইতিহাসের নতুন পাতা

চারপাশের মানুষজন ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে — বাংলা, উর্দু, মারাঠি, ফারসি, সব একসঙ্গে মিশে গেছে। কথাগুলোর টান শুনতে অদ্ভুত লাগছে, যেন সময়ের অন্য কোনো সুর ভেসে আসছে। কিন্তু একটা ব্যাপার দীপুর কানে বারবার ধাক্কা মারছে — কেউই ইংরেজি বলছে না!

সে হাঁটতে হাঁটতে একটা খবরের দোকানের সামনে থমকে দাঁড়ালো। দোকানের মাথার ওপরে মোটা হরফে লেখা — “রাজকীয় সংবাদ বিতান”। কাঠের দোকান, লাল টালির ছাদ, দুপাশে ঝোলানো লণ্ঠন থেকে উজ্জ্বল আলো ঝরছে। চারপাশের পরিবেশ যেন একেবারে অন্যরকম — এতটাই বাস্তব যে মনে হচ্ছে না এটা কোনো কল্পনার জগৎ। একজোড়া মোটা কাচের চশমা পরা এক বৃদ্ধ তাকে লক্ষ্য করছিলেন। চোখের চারপাশে গভীর ভাঁজ, পাতলা গড়ন, কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। দোকানের কাঠের তাকগুলিতে মোটা মোটা কাগজের বান্ডিল, হাতে লেখা কিছু নোটিস, আর লাল মোহর মারা সরকারি ঘোষণাপত্র সাজানো।

দীপু একটু দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে গেল, কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “একটা খবরের কাগজ দিতে পারবেন?”mলোকটা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। চোখ সরু করে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বলল, “তুমি দিল্লি থেকে এসেছো নাকি? তোমার উচ্চারণ কেমন যেন শুনাচ্ছে!” দীপু চমকে উঠল। “আমার বাংলা কি ওদের মতো নয়?”

সে দ্রুত খবরের কাগজ খুললো। কাগজটা আধুনিক কাগজের মতো মসৃণ নয় — মোটা, হাতে তৈরি কাগজের মতো। কালির গন্ধ এখনো টাটকা। সামনের বড় হেডলাইন — “পঞ্চম সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর আজ দিল্লি পৌঁছালেন!” দীপু থমকে গেল। বাহাদুর শাহ জাফর? পঞ্চম সম্রাট? তিনি কি এখনো রাজত্ব করছেন? তীব্র বাতাসে পাতা উল্টে গেল। চোখের সামনে আরও কিছু খবর — “হিন্দুস্তান সম্রাজ্যের শাসনকেন্দ্র পুনরায় দিল্লিতে স্থানান্তর। কলকাতার অর্থনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে।” “রাশিয়া ও তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে সম্রাটের নতুন নীতির ঘোষণা।” “বনহলদি বিদ্রোহের নেতা রাজগুরু কৃষ্ণনাথ কলকাতা আসছেন, ত্রিপুরা সীমান্তে প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ।” “মালাবার উপকূলে বণিকদের জন্য নতুন কর হ্রাসের নির্দেশনা জারি।” “কলকাতায় প্রথম বাষ্পচালিত বায়ুযান নির্মাণ প্রকল্পের ঘোষণা, আগামী বসন্তে উড়বে ‘রাজহংস’!”

দীপুর শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। তার হাতে ধরা কাগজের কালো কালি তখনো একটু ভেজা, মনে হচ্ছে ছাপা হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। চারপাশের লোকজন নিতান্ত স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছে, কারোর মুখে কোনো বিস্ময় নেই। দোকানের সামনে একজন কাগজ কিনে দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে কয়েকজন ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে যাচ্ছে। সব কিছুই স্বাভাবিক, যেন এটাই ওদের কাছে বাস্তব।

কাগজের পাতাগুলো দ্রুত উল্টাতে লাগলো। মাথার ভেতর চিন্তা ঝড়ের মতো ঘুরছে। “এটা কি সত্যি? ইতিহাস কি পাল্টে গেছে?”

নতুন পথে

চারপাশের মানুষজনকে দেখে দীপু ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে লাগল — এখানকার সবাই ভারতীয়, কিন্তু তাদের পোশাক, চালচলন, উচ্চারণ যেন এক অন্য সময়ের। কেউ পরে আছে লম্বা জরির কাজ করা কুর্তা, যার সোনালি সুতোয় সূক্ষ্ম নকশা আঁকা, যেন সূর্যাস্তের আলোয় তা মৃদু ঝলমল করছে। কারও পরনে রাজপুত ঘরানার গাঢ় লাল কোট, বুকে খোদাই করা সূর্য-চিহ্ন, ঠিক যেমন রাজপুত সেনাপতির বর্মে থাকত। কেউ আবার গভীর নীল রঙের ধাতব বর্মে মোড়া, গাঢ় চামড়ার জুতোয় ভারী ধাতব পাত বসানো, কোমরে ঝুলছে চকচকে কৃপাণ, যার ফলা গোধূলির কমলা আলোয় ঝলসে উঠছে।

রাস্তায় হালকা কুয়াশার আস্তরণ জমেছে, দিনের শেষ আলো ম্লান হয়ে আসছে। দীপু হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করল, রাস্তার ধারে উঁচু দালানগুলোর গায়ে মুঘল, মারাঠা ও দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণ — মনে হচ্ছে যেন ইতিহাসের নানা অধ্যায় একসঙ্গে মিশে এক নতুন শহর গড়ে তুলেছে। কোথাও মার্বেলের তৈরি মিনার, কোথাও মন্দিরের অলংকৃত স্তম্ভ, কোথাও রাজপ্রাসাদের ব্যালকনি। অনেক জায়গায় লণ্ঠনের মৃদু আলো জ্বলতে শুরু করেছে, যার আলোয় পাথরের গায়ে খোদাই করা রাজকীয় প্রতীকগুলো আরও রহস্যময় হয়ে উঠছে।

এটা যদি কলকাতা হয়, তাহলে এত বদলে গেল কীভাবে?

সামনে বিশাল প্রবেশদ্বার। উপরে খোদাই করা আছে — “শিবাজী ইউনিভার্সিটি”। ভারী শিলালিপিতে খোদাই করা শব্দগুলি গ্যাস ল্যাম্পের কমলা আলোয় আরও গম্ভীর মনে হচ্ছে — “বীরত্ব, জ্ঞান, স্বাধীনতা”। পাথরের ফলকের নীচে ছোট ছোট শিশুরা বসে অক্ষর শেখার চেষ্টা করছে, এক পাশে কয়েকজন তরুণ জটলা পাকিয়ে তর্ক করছে।

তার ঠিক পাশেই, স্টিমের ধোঁয়া ছড়িয়ে “টিপু সুলতান রেলওয়ে স্টেশন”। বিশাল ধাতব গম্বুজের নিচে বাষ্পীয় ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। তবে এটি আধুনিক স্টিম ইঞ্জিনের মতো নয়, বরং বর্মে মোড়া বিশাল এক যন্ত্র, যার মাথায় সূর্যের প্রতীক!

লোকজন ব্যস্তভাবে ট্রেন থেকে নামছে, কেউ আবার প্ল্যাটফর্মে উঠে বসছে। অনেকের হাতেই চকচকে ধাতব বাক্স, যা দেখতে অনেকটা রাজকীয় রাজসভার নথিপত্র বহনের কেসের মতো। ট্রেনের প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভারী অস্ত্রধারী সৈন্যরা, ব্যারেল বন্দুক কাঁধে, মুখ শক্ত, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।

দীপুর মাথা ঘুরছে। এই কলকাতা কতদূর এগিয়ে গেছে! “কিন্তু কীভাবে?” সে অসহায়ভাবে চারপাশে তাকাল, যেন কোথাও তার পরিচিত কোনও কিছু খুঁজে পাবে। সব কিছু এত বাস্তব যে মনে হচ্ছে না এটি কোনও স্বপ্ন।

ঠিক তখনই, তার চোখ ছুটে গেল আকাশের দিকে — সেখানে ভেসে আছে এক বিশাল এয়ারশিপ!

লম্বাটে ধাতব কাঠামো, তার নিচে সারিবদ্ধ গ্যাস ল্যাম্পের আলো, আর তার গায়ে ঝলমলে সোনালি রঙের বিশাল এক বাঘ — যেন এক লাফে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়! বিশাল হরফে লেখা রয়েছে — “হিন্দুস্তান বৈমানিক বাহিনী”। শহরের গম্বুজগুলোর ছায়ার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে বিশাল সেই এয়ারশিপ এগিয়ে চলেছে।

এর নিচে কাঁচের মতো স্বচ্ছ জানালা, যার মধ্যে দিয়ে উজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছে — সেখানে নিশ্চয়ই পাইলট এবং আরও অফিসাররা বসে আছে। ঠিক তখনই, তার অনুভূতি যেন আরেক ধাক্কা খেল —

একজন বিশালদেহী সৈনিক তার দিকে নজর দিল। ছ’ফুটের বেশি উচ্চতা, বলিষ্ঠ শরীর, নীল-সোনালি পোশাক, কোমরে রূপার খাপের তরবারি। গ্যাস ল্যাম্পের আলোয় তার ধাতব কাঁধের ব্যাজ ঝলসে উঠল — “হিন্দুস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনী”। সৈনিক ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কঠিন দৃষ্টিতে দীপুর দিকে তাকাল। “তুমি কি নব কলকাতার ছাত্র?” গলার স্বর দৃঢ়, কিন্তু কোনও বিদ্বেষ নেই — বরং যেন কিছু যাচাই করার চেষ্টা করছে। দীপু মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেল।

সে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে, যে সে আসলে অন্য এক ইতিহাস থেকে এসেছে?

একটি সাক্ষাৎকার

দীপু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, সৈনিকটা দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাব করে এগিয়ে গেল।দীপু মানুষের ভিড়ের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে এগিয়ে চললো। পুরো শহর যেন এক মহোৎসবের প্রস্তুতিতে রঙিন হয়ে উঠেছে। সোনার আলোর মালায় সজ্জিত রাজপথ, পতাকার সারি, আর চারপাশে উজ্জ্বল রঙের ব্যানার — সব জায়গায় লেখা একটাই কথা, “স্বর্ণজয়ন্তী ১৮৫৭ — ১৯০৭: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর”।

শহরের প্রতিটি গলি-মহল্লা যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে। দূর থেকে ঢাক-ঢোলের গম্ভীর শব্দ আসছে, যুদ্ধজয়ী সৈন্যদের গান শহরের বাতাসে মিশে গেছে। মন্দিরের ঘণ্টা, মসজিদের আজান আর বিশাল কামানের গর্জন একসাথে মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অভূতপূর্ব আবহ। উৎসবের মাঝে প্রতিটি পা যেন আরও শক্তিশালী, প্রতিটি মুহূর্ত যেন আরও উজ্জীবিত।

শহরের কেন্দ্রস্থলে বসেছে “স্বাধীনতা প্রদর্শনী” — যেখানে ১৮৫৭-র যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত। যুদ্ধের ব্যবহৃত তলোয়ার, পুরনো যুদ্ধ পতাকা, আর শহীদদের হাতে লেখা চিঠি সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় আয়োজন হচ্ছে আগামীকাল “স্বাধীনতা শোভাযাত্রা” — যেখানে শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে শুরু হবে এক বিশাল কুচকাওয়াজ, যা শেষ হবে ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে, যেখানে একসময় ব্রিটিশদের দুর্গ ছিল।

বর্ণাঢ্য পোশাক পরা মানুষজন ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমে এসেছে। মহিলাদের গাঢ় লাল-সোনালি শাড়ি, পুরুষদের বুকে খোদাই করা বাহাদুরী প্রতীক, মাথায় গেরুয়া-নীল-সবুজ পাগড়ি। শিশুরাও নতুন জামা পরে, হাতে ছোট ছোট পতাকা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।

এই ভিড়ের মধ্যেই দীপু বিশাল সিংহদ্বার পেরিয়ে একটা বিরাট সভাগৃহে পৌঁছালো। বিশাল প্রাঙ্গণের দেয়ালজুড়ে আঁকা রয়েছে ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের চিত্র — রানি লক্ষ্মীবাইয়ের অশ্বারোহণ, নানা সাহেবের তলোয়ার-উচ্চারণ, বাহাদুর শাহ জাফরের রাজ্যাভিষেক, আর মারাঠা, শিখ, পাঠান, বাঙালি, রাজপুত, দক্ষিণী সকল সৈন্যদের একসঙ্গে যুদ্ধের দৃশ্য।

ভিতরে ঢুকতেই তার চোখ পড়লো উচ্চ মঞ্চের ওপরে ঝুলতে থাকা এক বিশাল মানচিত্রের দিকে। মানচিত্রটা সাধারণ কাগজের নয় — মসলিনের ওপর হাতে আঁকা, যেখানে সোনার রঙে ফুটে উঠেছে এক নতুন ভারত। তার ওপরে খোদাই করা আছে “১৮৫৭: পুনর্জন্মের বছর”। চারপাশে ছোট ছোট লেখায় চিহ্নিত করা হয়েছে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্থান — দিল্লি, কানপুর, ঝাঁসি, গ্বালিয়র, ব্যারাকপুর, কলকাতা।

ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক দীর্ঘদেহী, সুদৃঢ় কিন্তু বয়সের ভারে একটু নত মানুষ। তার পা দুটো শক্ত হলেও হাঁটার গতি কিছুটা ধীর, শরীরের পেশীগুলো এখনো দৃঢ়, তবে বয়সের রেখা গভীর হয়েছে। তিনি লম্বা, গাঢ় নীল কোট পরে আছেন, যার কাঁধে মারাঠা সামরিক ব্যাজ সেলাই করা। কোমরে ঝুলছে এক পুরনো তলোয়ার, যার রূপালি খাপে খোদাই করা “স্বাধীনতা”। কিন্তু তার চোখের কোণে বয়সের চিহ্ন, যেন অনেক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় সময়ের চাপ স্পষ্ট, তবে তার উপস্থিতি এখনও এক পরাক্রমী নেতৃত্বের ইঙ্গিত দেয় ।চোখ দুটোতে জ্বলছে এক অম্লান দীপ্তি — বয়সের রেখা তীক্ষ্ণ হলেও দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা কমেনি।

দীপু শ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। “তাতিয়া টোপি!”

গল্পে পড়া, ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এক জীবন্ত কিংবদন্তি এখন তার সামনে। ১৮৫৭-র অন্যতম বীর সেনাপতি, নানা সাহেবের পরম সহযোগী, ভারতের যুদ্ধকৌশলের অন্যতম রূপকার।

তাতিয়া টোপি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন, দীপুর দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন। তার বয়স এখন নব্বই কি তারও বেশি? কিন্তু শরীরে এখনো যেন যুদ্ধের অভ্যস্ত কঠোরতা রয়ে গেছে।

“তুমি কি নতুন ইতিহাস খুঁজছ?”

দীপু কিছু বলতে পারছিল না। তাতিয়া টোপি একপাশের বিশাল মানচিত্রের দিকে তাকালেন।

“আমরা জিতেছিলাম, কারণ আমরা একসাথে লড়েছিলাম।” একটু থেমে যোগ করলেন, “স্বাধীনতা কেউ দেয় না, স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। আমরা একত্রিত হয়েছিলাম, নিজেদের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলাম।”

নতুন ইতিহাস

দীপু ফিসফিস করে বলল, “কিন্তু ইংরেজরা?” তাতিয়া টোপি হালকা হাসলেন। দীপুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ওরা ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে, কিন্তু জানো কীভাবে?” তাঁর গলায় এক ধরনের গভীরতা, যেন শত বছর আগের এক ঘটনা তিনি নতুন করে শোনাচ্ছেন।

দীপু কিছু বলল না, শুধু চুপচাপ তাকিয়ে রইল। তাতিয়া টোপি এক পা এগিয়ে মানচিত্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিশাল কাপড়ের মানচিত্র — সোনার রঙে আঁকা এক নতুন ভারত। “এটা একদিনে হয়নি, দীপু। আমরা ইতিহাসের চাকা ঘোরানোর জন্য নিজেদের বদলেছি।”

দীপু শ্বাস ধরে রইল। “শুনো,” তাতিয়া টোপি বললেন, “আমরা যদি এক না হতাম, তাহলে কিছুই বদলাত না। তাই আমরা এক হলাম।” তিনি হাত ঘুরিয়ে মানচিত্রে কয়েকটি জায়গা দেখালেন। “নানা সাহেব, রানী লক্ষ্মীবাই, বাহাদুর শাহ জাফর আর আমি একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম — ‘এটা যদি সত্যি স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়, তাহলে আমাদের একটাই বাহিনী হতে হবে।’ একবার ভাবো, ইংরেজরা যখন এলো, তখন তারা আমাদের আলাদা করে দিল, একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু আমরা এবার এক হলাম, আর সেইখানেই ইতিহাস বদলে গেল।”

তাতিয়া টোপি আঙুল দিলেন দিল্লির ওপর, তারপর সরিয়ে নিলেন কলকাতার দিকে। “আমরা দিল্লি নিয়েছিলাম, কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি — এটাই তো ইতিহাস বলছে, তাই না?” দীপু মাথা নাড়ল। “কিন্তু এবার আমরা পারলাম। দিল্লির প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করলাম, ইংরেজদের ঢুকতে দিলাম না। আর তখনই আমাদের সবচেয়ে বড় জয় হলো — কলকাতা।”

দীপু এক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “কলকাতা?” তাতিয়া টোপি মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ। ওটাই ছিল ইংরেজদের আসল শক্তি। বোম্বাই বা দিল্লি নয়, কলকাতা। এখানেই তাদের মূল কার্যালয়, ব্যাংক, কারখানা, বন্দর, সব কিছু। তাই আমরা পরিকল্পনা করলাম, যদি কলকাতা ধ্বংস না করে নিজেদের হাতে নিতে পারি, তাহলে ইংরেজদের শক্তি ভেঙে যাবে। আর আমরা সেটাই করলাম। একসাথে শুরু করলাম, একদিক থেকে নয় — তিনদিক থেকে! মহারাষ্ট্র, উত্তর ভারত আর বাংলার বাহিনী একই সঙ্গে আক্রমণ করল।”

তাতিয়া টোপি দীপুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আগে বিদ্রোহীরা আলাদা আলাদা লড়ছিল, একসাথে ছিল না, এটাই আমাদের ভুল ছিল। কিন্তু এবার আমরা সবাই একসাথে লড়লাম। রাজপুত, মারাঠা, শিখ, বাঙালি, পাঠান, দক্ষিণের তামিল সৈন্য — সবাই একসাথে। পাঞ্জাবের শিখরা আমাদের পাশে দাঁড়াল, কারণ আমরা তাদের বোঝাতে পারলাম — যদি আমরা হারি, তাহলে সবাই শেষ হয়ে যাবে। একবার আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর পর, শিখ বাহিনী পুরো উত্তর ভারতে ইংরেজদের দুর্বল করে দিল। বাংলার নৌবাহিনী মুম্বাইয়ের উপকূল অবরোধ করল, আর সিপাহী বিদ্রোহের সৈন্যরা দিল্লির প্রতিরক্ষা করল।”

দীপু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। “তাহলে…” তাতিয়া টোপি একটু হাসলেন। “এবার ইংরেজদের তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলা হলো। ওরা জানল না, কোথায় প্রতিরোধ করবে।” তিনি আঙুল দিয়ে কলকাতার বন্দর চিহ্নিত করলেন। “আমরা ইংরেজদের সবচেয়ে বড় শক্তি কেড়ে নিলাম — তাদের খাবার ও অস্ত্র সরবরাহের পথ। তারা রেলপথে সৈন্য আনতে পারত, সমুদ্রপথে খাবার ও বন্দুক আনত, কিন্তু আমরা সেই পথ বন্ধ করে দিলাম। কলকাতার বন্দর আর বোম্বাইয়ের নৌঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা হলো।” দীপু শুকনো কণ্ঠে বলল, “তাহলে ওদের সৈন্যরা?” তাতিয়া টোপি মৃদু হেসে বললেন, “তারা খাবার পেল না, বন্দুক পেল না। তারা দুর্বল হয়ে পড়ল।”

দীপু চুপ করে রইল। তাতিয়া টোপি এবার একটু থেমে বললেন, “আমরা শুধু যুদ্ধের ময়দানে লড়িনি, দীপু। আমরা লড়েছি এমনভাবে, যা ইংরেজরা কল্পনাও করতে পারেনি। আমরা হঠাৎ আক্রমণ করতাম, শহরে ঢুকে যেতাম, আবার অদৃশ্য হয়ে যেতাম। আমাদের ছোট ছোট দল ছিল, যারা পাহাড়ে, নদীর ধারে আর গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে ইংরেজদের ওপর আঘাত হানত। তারা কোথাও নিরাপদ ছিল না। আর তাই ওরা হেরে গেল।” দীপু ধীরে ধীরে শ্বাস নিল।

তাতিয়া টোপি এবার শান্ত গলায় বললেন, “আমরা শুধু নিজেদের ওপর নির্ভর করিনি। আমরা ফ্রান্স, রাশিয়া আর তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওরা চেয়েছিল ব্রিটিশদের দুর্বল করতে, তাই আমাদের অস্ত্র আর টাকা পাঠিয়েছিল। আমরা সেই সুযোগ নিলাম। আর তখনই ইংরেজদের সমস্যাটা আরও বেড়ে গেল।” দীপু এবার বলল, “কী সমস্যা?”

তাতিয়া টোপি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইংরেজরা আবার সৈন্য আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তখনই ওদের ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।” দীপু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। “এই জগতে ক্রিমিয়াযুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি। ওদের সৈন্যদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে হয়েছিল। তাই আমাদের বিরুদ্ধে পুরো শক্তি আনতে পারেনি।” দীপু বুঝতে পারল, ইংরেজদের নিজের যুদ্ধই তাদের পিছিয়ে রেখেছিল।

তাতিয়া টোপি এবার ধীর গলায় বললেন, “আঠেরোশো সাতান্ন সালে যা করা উচিত ছিল, এবার আমরা সেটাই করলাম। নিজেদের রক্ষা করতে পারলাম। ইংরেজদের সরিয়ে দিলাম।” দীপু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তাতিয়া টোপি এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন, তারপর হালকা হাসলেন। “তাই তো বললাম, ওরা ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে।”

দীপু তখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছে .. এক নতুন ইতিহাস, এক নতুন ভারত, এক স্বাধীন বাস্তব। তার বুকের ভেতর যেন কিছু নড়ে উঠল। ইতিহাস কি সবসময় একটাই থাকে? নাকি বদলানো যায়? এই প্রশ্নের উত্তর কি সে সত্যিই জানে?

হয়তো জানে। হয়তো জানে না।

তবে তাতিয়া টোপি বললেন, “এটা বলা কঠিন। কিন্তু যারা ইতিহাস বোঝে, তারাই ভবিষ্যৎ বদলাতে পারে।”

বর্তমান

হঠাৎ, সব কিছু কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেল। দালান, এয়ারশিপ, সেনারা — সব অদৃশ্য হয়ে গেল। দীপু ঝটকা মেরে উঠে বসল। তার ঘর, জানলা, বিছানা — সব আগের মতো! ঘরের পুরনো রং, জানালার পাশে রাখা পাতা — সব যেন পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে। কিন্তু… কিছু একটা আলাদা লাগছিল। সে চোখ বন্ধ করল, আবার খোলার পর দেখে, বইটা তার পাশে পড়ে রয়েছে। তিতিবিরক্ত হয়ে হাত বাড়িয়ে বইটা তুলে নিলো। কিন্তু… বইয়ের নাম বদলে গেছে! “১৮৫৭ — হিন্দুস্তানের জয়” দীপু-এর গলা শুকিয়ে গেল। সে বইটা আবার খুলে দেখল, সমস্ত অক্ষর সুনির্দিষ্টভাবে লেখা, কিন্তু কিছু যেন অন্যরকম ছিল। মনে হচ্ছিল, এই বইয়ে এক নতুন ইতিহাস লেখা হয়েছে, যা সে কখনো আগে পড়েনি।

“ইতিহাস কি শুধুই পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি? না কি আমরা সবসময় তা বদলে দেওয়ার শক্তি রাখি?” সে গভীর চিন্তায় ছিল, মনে হচ্ছিল তার চারপাশে ইতিহাসের চাকা আবার ঘুরছে।

জানলার বাইরে হাওড়া ব্রিজ দাঁড়িয়ে আছে, আর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। বাতাসে কিছু একটা যেন বদলানোর সুর ভেসে আসছে। দূরে কোথাও ঢোলের বাজনা শোনা গেল। সেই শব্দের মধ্যে যেন কিছু একটা ছিল, যা দীপুকে এক নতুন রহস্যের দিকে টানছিল। তার চোখে নতুন কিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কী সেটা, সে নিজেও জানে না।

“হয়তো কোথাও কিছু হচ্ছে, যা আমি জানি না,” দীপু ভাবছিল। “কিন্তু… যদি এটা আসলেই কিছু নতুন হয়? তাহলে আমি কীভাবে জানব, যদি না খুঁজে দেখি?” তার মনে প্রশ্ন ঘুরছিল, “কিন্তু কেন সবকিছু বদলাতে হবে? কিছু তো আগের মতোই ভালো ছিল!”

তার চোখ জানালার বাইরে আরেকবার বিক্ষিপ্তভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, যেন সেই উত্তর কোথাও লুকিয়ে আছে, কিন্তু কিভাবে তাকে খুঁজে বের করবে সে জানে না।

আপনাদের দীপুর ভ্রমণ অ্যাডভেঞ্চার কেমন লাগল? কী ভাবছেন, দীপু এবার পরের গল্পে অতীত অথবা বর্তমানে কোথায় যেতে পারে? আপনার মতামত বা প্রশ্ন জানালে ভালো লাগবে। আরো আলোচনা করতে চাইলে LinkedIn বা Medium-এ যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top

Share Your Thoughts with Us

Meet our Quantum Travelers: Alice, an ace soccer player who understands the world through motion and action, and Bob, a scientist excited to step out of theory and experience quantum physics firsthand! Together, they journey into the strange world of Quantum Physics and find out.

Your Testimonial is Valuable to Us

Meet our Quantum Travelers: Alice, an ace soccer player who understands the world through motion and action, and Bob, a scientist excited to step out of theory and experience quantum physics firsthand! Together, they journey into the strange world of Quantum Physics and find out