1. দীপুর ভ্রমণ শুরু হলো (লন্ডনে)

দীপু, যার পুরো নাম দীপেশ রায়, আট বছরের খুবই কৌতূহলী স্বভাবের একটি ছেলে। সে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাপীঠের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাড়িতে তার বাবা-মা আর বড় দাদা বিট্টু থাকে। বিট্টু, অর্থাৎ ব্রজেশ রায়, দশম শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনায় ভীষণ ভালো এবং পরিবারের গর্ব। দীপু তার দাদাকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু মনে মনে ভাবে, “দাদা সারাদিন কীভাবে এত পড়তে পারে?” তার নিজের কিন্তু পড়ার চেয়ে খেলাধুলাতেই বেশি আনন্দ।

গত সপ্তাহে দীপুর ক্লাস থ্রির ফল প্রকাশ হয়েছে। সে তার ক্লাসে প্রথম হয়েছে। এই খবরে মা-বাবা খুব খুশি। তারা পুরস্কার হিসেবে গরমের ছুটিতে তাকে পুরী নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। দীপু খুশিতে আত্মহারা। পুরী যাওয়ার খবর শুনে তার মনে নতুন স্বপ্ন জাগে। সে ভাবে, “ভালো পড়াশোনা করলে হয়তো একদিন পৃথিবীর আরও দূরের জায়গায় যেতে পারব!”

এই বছর ভূগোল বইয়ে নতুন অধ্যায় এসেছে — বিশ্ব মানচিত্র। এতদিন বহরমপুর আর পাশের কলকাতার বাইরে তার দৃষ্টিই যায়নি। এবার সে জানতে পারছে ইউকে, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া আর আফ্রিকার কথা। বইয়ের রঙিন মানচিত্রে লন্ডনের ছবি দেখে তার কল্পনার ডানা মেলে। লন্ডন ব্রিজ, টেমস নদী আর বিগ বেন-এর ছবি যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে ভাবে, “যদি একদিন সেখানে যেতে পারতাম!”

একদিন বিকেলে, স্কুল থেকে ফিরে ভূগোল বই নিয়ে বসেছিল দীপু। পৃথিবীর মানচিত্র দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, সে নিজেও জানল না।

লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশন

দীপু হঠাৎ চমকে উঠল। তার চারপাশটা যেন এক মুহূর্তে পাল্টে গেছে। সে এখন আর বহরমপুরের ঘরে নয়, লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশনে বসে! চারদিকে মানুষের ব্যস্ততা। কেউ ট্রেনে উঠছে, কেউ নামছে। স্টেশনের দেয়ালে ঝকঝকে বড় বড় বোর্ডে ট্রেনের সময় আর গন্তব্য লেখা। “এডিনবরো,” “ম্যানচেস্টার,” “লিভারপুল” — এই নামগুলো সে ভূগোল বইয়ে দেখেছে। এখন সেই নামগুলো স্টেশনের বোর্ডে দেখে তার মনে হচ্ছে যেন বইয়ের পাতা থেকে সব বাস্তবে নেমে এসেছে। স্টেশনের ছাদটা এত উঁচু, যেন কাঁচের গম্বুজ। ছাদের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে ভেতরে পড়ছে। পুরো স্টেশন যেন সোনালি আলোয় ঝলমল করছে। মেঝেটাও আয়নার মতো মসৃণ আর পরিষ্কার। একটুকরো কাগজও পড়ে নেই, ধুলো তো দূরের কথা।

দীপু চারদিকে তাকিয়ে ভাবল, “এখানে কেউ কিছু ফেলে না? এত পরিষ্কার! বহরমপুরের স্টেশনে তো শুকনো পাতা আর খাবারের প্যাকেট ছড়িয়ে থাকে। এখানে সেটা যেন কল্পনাও করা যায় না।” লোকজন খুব ব্যস্ত। কেউ বড় বড় ব্যাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাতে নয়, চাকাওয়ালা ট্রলিতে! এই প্রথম এমন কিছু দেখে দীপু বিস্ময়ে ভেবেই যাচ্ছে, “এটা আবার কী? ভারী ব্যাগ হাত দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার বদলে চাকার সাহায্যে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে! এত সহজ!”

স্টেশনের অন্য পাশে দেখল, কেউ কেউ স্যুটকেস নিয়ে একটা বড় মেশিনে চলা সিঁড়িতে উঠে যাচ্ছে। দীপু থমকে দাঁড়িয়ে সেই সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। “এটা তো সাধারণ সিঁড়ি নয়! এটা নিজে নিজে নড়ছে!” সে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল, কেউ সিঁড়িতে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে, আর সিঁড়ি তাদের ওপরে বা নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। দীপু কিছুক্ষণ সেই মেশিনের দিকে তাকিয়ে ভাবল, “আমি কি এই সিঁড়িতে উঠতে পারব? পড়ে গেলে কী হবে?”

তার চেয়ে বড় বিস্ময় ছিল লিফট। কিছু মানুষ একটা বাক্সের মতো জায়গায় ঢুকছে, আর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলছে, আর মানুষগুলো একতলা ওপরে চলে যাচ্ছে। “এটা কি জাদু?” দীপু বিস্ময়ে তাকিয়ে ভাবল। “আমাদের বহরমপুর স্টেশনে তো শুধু সাধারণ সিঁড়ি, এরকম কিছুই নেই!” এমন সময় কেউ তার কাঁধে হাত রাখল। “হাই, আমি অলিভার। তুমি কি নতুন এসেছ?”

দীপু ঘুরে তাকিয়ে দেখল, তার সামনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে গাঢ় নীল রঙের জ্যাকেট, গলায় লাল মাফলার, আর পায়ে মোটা কালো বুট। হাতে দস্তানা। ছেলেটি মিষ্টি করে হাসছে। দীপু তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। ছেলেটির জামাকাপড় দেখে তার মনে পড়ল, “এগুলো তো সিনেমার পোশাকের মতো! এত বড় জ্যাকেট আর টুপি কেউ পরে? এখানে কি সবাই এমন সাজগোজ করে থাকে?”

অলিভার তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। দীপু একটু চমকে উঠল। “এটা কেন করছে?” সে মনে পড়ল, সিনেমায় দেখেছে বিদেশিরা এভাবে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে। কিন্তু তার তো “নমস্কার” করার অভ্যাস। তবু দ্বিধা কাটিয়ে সে ডান হাত বাড়াল। অলিভার তার হাতটা শক্ত করে ধরে নেড়ে বলল, “তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল!”

দীপু বুঝল, অলিভারের হাতটা গরম, কারণ সেটা মোটা দস্তানায় ঢাকা। আর তার নিজের হাতটা বরফের মতো ঠাণ্ডা। শীতের তীব্রতা তার হাফপ্যান্টের নিচে খোলা পায়ের অংশে কাঁপুনি ধরাচ্ছে। অলিভার খেয়াল করল, দীপু ঠাণ্ডায় কাঁপছে। সে চিন্তিত হয়ে বলল, “ওহ না, তুমি তো পুরো কাঁপছ! অপেক্ষা করো।” এই বলে অলিভার তার ব্যাগ খুলে ভেতর থেকে একটা লম্বা উলের ওভারকোট আর একটা নরম চেক প্ল্যাড প্যান্ট বের করল। “এই নাও, এগুলো পরো!”

দীপু চমকে তাকিয়ে বলল, “ওভারকোট পরব, কিন্তু এই প্যান্টটা কীভাবে পরব?” অলিভার হাসতে হাসতে বলল, “চিন্তা কোরো না। এটা তোমার হাফপ্যান্টের ওপর পরো। ঠাণ্ডা আর লাগবে না।” দীপু দ্রুত চেক প্ল্যাড প্যান্টটা পরে নিল। আর ওভারকোট তার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢেকে দিল। সে নিজেকে দেখে হেসে বলল, “এটা কী মজার! আর একটু ঠাণ্ডা লাগছে না!” অলিভার মৃদু হেসে বলল, “আমি সবসময় অতিরিক্ত গরম পোশাক সঙ্গে রাখি। লন্ডনের ঠাণ্ডা খুব খারাপ হতে পারে।”

দীপু এবার পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ বোধ করল। তার মনে হল, এত বড় আর অপরিচিত জায়গায়ও এমন কেউ আছে, যে তাকে সাহায্য করতে পারে। “চলো, আমি তোমাকে লন্ডন ঘুরিয়ে দেখাব,” বলল অলিভার। দীপু আর দ্বিধা করল না। অলিভারের হাত ধরে সে তার লন্ডন যাত্রার প্রথম ধাপ পা বাড়াল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে একবার পেছনে ফিরে তাকাল। বিশাল দরজা দিয়ে আসা আলো দেখে মনে হল, এটা যেন কোনও এক রাজপ্রাসাদ। বহরমপুরের স্টেশনের তুলনায় এটা এতই বিশাল আর ঝকঝকে যে তার চোখ সরানোই কঠিন হয়ে পড়ল।

লন্ডনের রাস্তায়

স্টেশন থেকে বের হতেই দীপু থমকে দাঁড়াল। তার চোখ আটকে গেল বিশাল লাল রঙের ডাবল ডেকার বাসে। বাসটা এত বড় আর চকচকে লাল রঙের যে দীপু আগে কখনও এমন কিছু দেখেনি। তার মনে পড়ল, ভূগোল বইয়ে এরকম বাসের ছবি দেখেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখার অভিজ্ঞতা একেবারে অন্যরকম। বাসের ওপরের তলাটা দেখে সে অবাক হয়ে বলল, “এগুলো এত বড়! আমি কি ওপরে বসতে পারি?” অলিভার হেসে বলল, “চলো! আমরা উপরে সামনের সিটে বসব। সেখান থেকে পুরো শহরটা খুব ভালোভাবে দেখতে পারবে।”

তারা বাসে উঠে উপরের তলায় গেল। ধাতব সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় দীপু সিঁড়ির রেলিংটা ধরে একটু ধীরে ধীরে উঠল। মনে হল, সে যেন কোনও অদ্ভুত যন্ত্রের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ওপরে পৌঁছে সামনের সিটে বসে জানালার পাশে জায়গা নিল। আগে থেকেই সে লক্ষ্য করেছিল, আজ আকাশটা কত নীল, দূষণ কত কম। অনেক দূর অবধি দেখা যাচ্ছে। অলিভার বলল, “সাধারণত প্রায়ই এখানে বৃষ্টি হয়। আজ রোদ বেরিয়েছে, তাই সেজন্য অনেক মানুষ রোদ উপভোগ করতে বাইরে এসেছে।”

রাস্তা দেখে দীপু প্রথমেই ভাবল, “এখানে তো একটাও রিকশা বা অটো নেই!” সে জানালার বাইরে তাকিয়ে আরও খেয়াল করল, রাস্তায় শুধু লাল বাস আর কালো ট্যাক্সি চলছে। কিছু ব্যক্তিগত গাড়িও আছে, কিন্তু খুব বেশি নয়। দীপু অবাক হয়ে বলল, “তোমাদের এখানে অটো বা রিকশা নেই? তাহলে মানুষ কোথায় করে যায়?” অলিভার বলল, “রিকশা বা অটো নয়। আমাদের এখানে লোকেরা বাস, ট্যাক্সি, সাইকেল, আর ভূগর্ভস্থ ট্রেন ব্যবহার করে। কেউ কেউ নিজের গাড়ি চালায়, কিন্তু শহরের ভেতর পাবলিক ট্রান্সপোর্টই বেশি চলে।”

বড় বড় রাস্তা, একদম মসৃণ আর ধুলোবালি নেই। রাস্তার দুই পাশে চকচকে ফুটপাথ। কিন্তু তার চোখে প্রথমেই ধরা পড়ল, “কোথাও ফুটপাথে কোনও চায়ের দোকান বা ছোটখাটো দোকান নেই! এগুলো শুধু মানুষ হেঁটে যাওয়ার জন্য।” দীপু তাকিয়ে দেখল, ফুটপাথের পাশে আলাদা জায়গা সাইকেলের জন্য। রঙিন দাগ দিয়ে সাজানো পথ আর কিছু মানুষ সেখানে সাইকেল চালাচ্ছে। সে ভাবল, “এগুলো কি আলাদা সাইকেলের রাস্তা? এত পরিকল্পনা করে বানানো!”

রাস্তার ধারে বড় বড় গাছ। প্রতিটা গাছ একদম একই মাপে কাটা, যেন সোজা লাইন দিয়ে সাজানো। গাছগুলোর নিচে ছোট ছোট ফুলের বাগান। ফুলগুলো এত পরিষ্কার আর সুন্দর করে রাখা। বাস চলতে চলতে সে লক্ষ্য করল, রাস্তায় সবাই একটা লাইনে চলছে। কোনও গাড়ি অকারণে হর্ন বাজাচ্ছে না। রাস্তায় ট্রাফিক লাইট ঠিকঠাক চলছে। কেউ গাড়ি নিয়ে কোনও নিয়ম ভাঙছে না। দীপু বলল, “তোমাদের গাড়িগুলো এত সুন্দর আর শান্তভাবে চলে। এখানে তো কিছুতেই বিশৃঙ্খলা নেই।” অলিভার হেসে জানাল, “এখানে সবাই রাস্তার নিয়ম মানে। নিয়ম ভাঙলে খুব বড় জরিমানা দিতে হয়।”

বাস ধীরে ধীরে পিকাডিলি সার্কাস-এর দিকে এগোল। দীপু জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, রাস্তার পাশের বড় বড় ভবনগুলো আলাদা আলাদা আকারের হলেও সেগুলো একই ধরনের কাঠামোয় তৈরি। কোথাও কোন অগোছালো কিছু নেই। এবার তার চোখে হঠাৎ ধরা পড়ল কিছু অদ্ভুত লাল বাক্স। “ওগুলো কী?” দীপু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল। অলিভার বলল, “ওগুলো আমাদের রেড টেলিফোন বক্স। এখন সবাই মোবাইল ব্যবহার করে, কিন্তু এগুলো লন্ডনের প্রতীক। এগুলো আমাদের ইতিহাসের অংশ।”

বলতে বলতেই বাস পিকাডিলি সার্কাস নামক এক জায়গায় পৌঁছাল। সঙ্গে সঙ্গে দীপু চারদিকে বিশাল স্ক্রিনে বিজ্ঞাপন দেখতে পেল। স্ক্রিনগুলো এত বড় যে সে প্রথমে ভেবেছিল এগুলো বাড়ির জানালা। স্ক্রিনে গাড়ির ছবি, খাবারের বিজ্ঞাপন আর বড় বড় কোম্পানির নাম দেখে সে বলল, “এগুলো এত বড় কেন?” অলিভার জানাল, “এটা লন্ডনের সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গাগুলোর একটা। এখানে সব সময় ভিড় থাকে। বড় বড় স্ক্রিনে বিজ্ঞাপন দেখাতে অনেক টাকা খরচ হয়।”

দীপু খেয়াল করল, রাস্তার মোড়গুলো গোলাকার আর একই ধরনের। সে ভাবল, “এখানে সব রাস্তা একই ধরনের! কোথাও ভাঙা রাস্তা নেই। সবকিছু এত পরিকল্পিত! এটা যেন একটা গল্পের শহর।” বাস আবার চলতে শুরু করল। দীপু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মানুষের চলাফেরা দেখতে লাগল। সে লক্ষ্য করল, সবাই খুব দ্রুত চলাফেরা করছে। কেউ ফোনে কথা বলছে, কেউ ছোট ছোট ব্রিফকেস হাতে অফিসের দিকে যাচ্ছে।

অবশেষে দীপু রাস্তায় দেখা লাল বাস, কালো ট্যাক্সি আর সাজানো ভবনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “এগুলো ঠিক আমাদের হলুদ ট্যাক্সিগুলোর মতো! লাল বাস আর কালো ট্যাক্সি দেখলেই বুঝতে পারি আমি লন্ডনে। আমাদের মতো এখানকার বাস-ট্যাক্সিগুলোও যেন শহরের প্রতীক।” চারপাশের পরিচ্ছন্নতা, সাজানো রাস্তা, আর মানুষের শৃঙ্খল দেখে দীপু ভাবল, “এটা যেন সত্যি কোনও রাজ্যের গল্প।” অলিভার বলল, “তুমি লন্ডন শহরের আরও অনেক জায়গা দেখতে পারবে। এখন আমরা টিউব-এ যাব।” “টিউব মানে কী?” দীপু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল। “এটা আমাদের মাটির নিচ দিয়ে চলা ট্রেন। পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে।” দীপু শোনার সঙ্গে সঙ্গে আর অপেক্ষা করতে পারল না। তার মনে হল, বাস থেকে নামার পর একটা নতুন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে।

লন্ডনের টিউব

এরপর তারা গেল লন্ডনের বিখ্যাত টিউবে। বাইরে থেকে দীপু স্টেশনের প্রবেশপথটা খুব সাধারণ মনে হল। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। চারপাশে এত আলো আর এত বড় জায়গা দেখে সে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকেই দীপু খেয়াল করল, চারদিকে মানুষের ব্যস্ততা। কেউ মাটির নিচে নামছে ধাতব সিঁড়ি বেয়ে, কেউ চলন্ত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিচে যাচ্ছে। যন্ত্রে চলা সিঁড়ি তাকে আগেই অবাক করেছিল, কিন্তু এখানে একসঙ্গে এতগুলো দেখে সে আরও অবাক হয়ে গেল। “এত বড় জায়গা! সবাই এত দ্রুত কোথায় যাচ্ছে?” দীপু জানতে চাইল। অলিভার হেসে বলল, “এটা লন্ডনের টিউব। পৃথিবীর প্রথম ভূগর্ভস্থ ট্রেন। এখান থেকে লন্ডনের প্রায় সব জায়গায় যাওয়া যায়।”

তারা প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোল। দীপু লক্ষ্য করল, স্টেশনের মেঝে আর দেয়াল এত ঝকঝকে পরিষ্কার যে কোথাও ধুলো নেই। দেয়ালে বড় বড় বোর্ডে নির্দেশনা লেখা। কিছু বোর্ডে যাত্রীদের জন্য হুঁশিয়ারি, যেমন, “মাইন্ড দ্য গ্যাপ”। দীপু বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু অনেকগুলো ইংরেজি শব্দ তার অচেনা। “এখানে এত সাইনবোর্ড কেন?” দীপু জানতে চাইল। “টিউব স্টেশনগুলো বড়, আর এখানে অনেক লাইন আছে,” অলিভার বোঝাল। “সাইনগুলো দেখলেই বুঝতে পারবে, কোথায় যেতে হবে।”

দীপু আরও খেয়াল করল, স্টেশনের ভেতরে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোচ্ছে। ঠেলাঠেলি নেই। কেউ একে অপরের সামনে ঢুকছে না। দীপু এই শৃঙ্খলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবল, “আমাদের দেশে যদি এভাবে সবাই লাইন মানত!” ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে দীপু শুনল, দূর থেকে একটা গর্জন আসছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই সে একটা তীব্র আলো দেখতে পেল। এরপর দ্রুত গতিতে একটা ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে থামল। ট্রেনের গতিবেগ দেখে দীপু একটু পিছিয়ে গেল। “ট্রেনটা এত দ্রুত চলে!” সে বিস্ময়ে বলল। অলিভার মাথা নেড়ে বলল, “টিউব ট্রেনগুলো খুব দ্রুত চলে, যাতে মানুষ সময় বাঁচাতে পারে।”

ট্রেনের দরজা খুলতেই দীপু ভেতরে ঢুকল। ট্রেনের ঝকঝকে ভেতরটা দেখে তার চোখ গোল হয়ে গেল। সিলিং থেকে ঝলমলে আলো, পরিষ্কার মেঝে, আর বড় বড় আরামদায়ক সিট দেখে দীপু অবাক হয়ে ভাবল, “এটা তো আমাদের কলকাতার মেট্রোর মতো নয়! এত পরিষ্কার আর সুন্দর কীভাবে!” দীপু বলল, “এত মানুষ প্রতিদিন এটা ব্যবহার করে, তাও এটা এত পরিষ্কার থাকে কীভাবে?” অলিভার মুচকি হেসে বলল, “এখানে ট্রেনগুলো রোজ পরিষ্কার করা হয়। আর সবাই নিয়ম মেনে চলে। কেউ কিছু ফেলে না।”

দীপু ট্রেনের জানালার দিকে তাকাল। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু কালো দেওয়াল। সে জানতে চাইল, “এখানে বাইরের কিছু দেখা যায় না কেন?” “টিউব মাটির নিচ দিয়ে চলে। বাইরের কিছু দেখতে পাবে না, কিন্তু খুব দ্রুত পৌঁছে যাবে,” অলিভার বলল। দীপু মনে পড়ল, তারাও কলকাতায় মেট্রো বলে একটা ট্রেনে চড়ে। সে ভাবল, “আমাদের মেট্রোও মাটির নিচ দিয়ে চলে। এটা এত বড় নয়, কিন্তু আমরাও মেট্রোতে পুরো শহর ঘুরি!”

ট্রেন চলতে শুরু করল। গতি দেখে দীপু মনে মনে ভাবল, “এটা তো রকেটের মতো চলে!” সে জানালার ধারে বসে ভেতরের সাজসজ্জা আর যাত্রীদের দেখল। সবাই খুব শান্তভাবে বসে আছে, কেউ জোরে কথা বলছে না। ট্রেনের মৃদু শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ শোনা যায় না। তাদের ট্রেন একটা স্টেশনে থামল। দরজা খুলতেই নতুন যাত্রী ঢুকল। দীপু লক্ষ্য করল, সবাই খুব নিয়ম মেনে ট্রেন থেকে নামছে আর উঠছে। কেউ কোথাও ভিড় করছে না।

“এখানে সবকিছু এত নিয়মমাফিক!” দীপু জিজ্ঞেস করল। অলিভার বলল, “কারণ, এখানে সবাই সময়ের গুরুত্ব বোঝে। টিউব ট্রেনের পুরো সিস্টেমটাই এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কোনো ঝামেলা ছাড়া হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে যাতায়াত করতে পারে।” দীপু একটা ম্যাপ দেখল, যেটা ট্রেনের দেওয়ালে ঝুলছে। সেখানে টিউব লাইনগুলোর সব নাম আর রঙের দাগ বোঝানো হয়েছে। দীপু বলল, “এটা কেন এত রঙিন?” অলিভার বলল, “এটা লন্ডনের টিউব ম্যাপ। প্রতিটি লাইন আলাদা রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। তুমি যদি রঙ আর নাম মনে রাখো, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবে কোথায় যেতে হবে।” দীপু মাথা নাড়ল। সে ভাবল, “এত বড় একটা শহরে মানুষ কত বুদ্ধি খাটিয়ে চলাচল করে!”

বিগ বেন আর টাওয়ার ব্রিজ

টিউব থেকে নেমে দীপু আর অলিভার পৌঁছাল বিখ্যাত বিগ বেন-এর কাছে। বিশাল ঘড়ি আর তার পাশে আকাশচুম্বী টাওয়ার দেখে দীপু থমকে দাঁড়াল। প্রথমে সে বুঝতেই পারছিল না, এমন বড় একটা ঘড়ি কীভাবে আসল হতে পারে। ঘড়িটা এত বড় যে দীপু নিজের মাথা উঁচু করে পুরোটা দেখতে লাগল। তার মনে হল, এ যেন ভূগোল বইয়ের ছবি থেকে জীবন্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছে। “এটা তো জাদুর ঘড়ির মতো! এটা কি সত্যি কাজ করে?” দীপু বিস্ময়ে বলল। অলিভার হেসে বলল, “হ্যাঁ, এটা কাজ করে। এই টাওয়ারটার নাম এলিজাবেথ টাওয়ার। আর ঘড়িটার আসল নাম বিগ বেন। এটা লন্ডনের সবচেয়ে বড় প্রতীক। দীপু মুগ্ধ হয়ে ভাবল, “আমাদের মন্দিরের ঘণ্টার মতোই বাজে, কিন্তু এটা অনেক বড়। এটার শব্দ কেমন হয়?” অলিভার বলল, “প্রতি ঘণ্টায় এর ঘণ্টাধ্বনি পুরো এলাকায় শোনা যায়।”

ঘড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তারা ছবি তুলল। অলিভার বলল, “তুমি এটা তোমার মা-বাবাকে দেখাতে পার।” দীপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, মা বলবেন, আমি কত মজার জায়গায় গেছি। দাদা এটা দেখে অবাক হয়ে যাবে!” বিগ বেন-এর নিচে দাঁড়িয়ে তারা নদীর ধারের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে দীপু দেখল, টেমস নদীর ওপর লম্বা একটা ব্রিজ। দূর থেকেই ব্রিজের সাজানো রঙ আর নকশা তাকে মুগ্ধ করল। অলিভার জানাল, “এটা টাওয়ার ব্রিজ। টেমস নদীর ওপর দিয়ে শহরের দুই দিককে যুক্ত করে। আর জানো, এর মাঝখানটা খুলে বড় বড় জাহাজ যাওয়ার জায়গা দেয়।”

তারা ব্রিজের ওপর হাঁটতে লাগল। দীপু দেখল, টেমস নদীর ওপর অনেকগুলো জাহাজ চলেছে। কিছু বড় বড় যাত্রীবাহী জাহাজ। তাদের ওপর ছাতা বসানো, আর মানুষজন সেখানে বসে খাচ্ছে, গান শুনছে। “এই জাহাজগুলো কি এখানকার বাসিন্দাদের জন্য, না শুধু ভ্রমণকারীদের?” দীপু জানতে চাইল। অলিভার বলল, “দুটোই। কিছু জাহাজে পর্যটকরা টেমস ঘুরে দেখেন। আবার কিছু জাহাজ পিকনিকের মতো ব্যবহৃত হয়।”

দীপু ব্রিজের একপাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকাল। টেমস-এর জল স্পষ্ট, আর সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি করছে। “টেমস নদীর জল এত পরিষ্কার কেন?” দীপু জানতে চাইল। “কারণ, টেমস-কে আমরা খুব যত্ন করে রক্ষা করি। নদীর জলকে দূষিত হতে দিই না। টেমস লন্ডনের অন্যতম পরিচিতি।” দীপু ভাবল, “এটা কত সুন্দর! এমন নদীর ওপর ব্রিজে দাঁড়িয়ে পুরো শহর দেখা যায়!”

তারা ব্রিজের মাঝখানে পৌঁছাল। দীপু লক্ষ্য করল, ব্রিজের কিছু অংশ খুলে যাচ্ছে। বিশাল একটা জাহাজ ধীরে ধীরে নিচ দিয়ে পার হচ্ছে। দীপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “এটা কি সত্যি? ব্রিজটা খুলে যাচ্ছে! এটা কি যন্ত্র দিয়ে চলে?” অলিভার মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, এটা একেবারে যন্ত্রচালিত। ব্রিজের নিচে বড় বড় যন্ত্র বসানো আছে। ব্রিজটা খুলে জাহাজকে যাওয়ার জায়গা দেয়। টেমস-এ বড় জাহাজ চলাচল করতে পারে বলেই এটা এত বিখ্যাত।” দীপু যেন পুরো ব্রিজটা আর একবার ভালো করে দেখল। তার মনে হচ্ছিল, এটা কোনো এক জাদুর শহরের অংশ। “এটা তো জাদুর মতো!” দীপু বলল। “আমাদের দেশে যদি এমন ব্রিজ থাকত, কত মজা হতো!”

তারা ব্রিজের ওপরে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে টেমস নদীর ওপরের দৃশ্য উপভোগ করল। দূরে দ্য শার্ড, উঁচু একটা বিল্ডিং, আকাশ ছুঁতে চায় যেন। অলিভার দেখিয়ে বলল, “ওটা দেখো, দ্য শার্ড। এটা লন্ডনের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং।” টাওয়ার ব্রিজ থেকে নামার পর দীপু আর অলিভার টেমস-এর ধারের ছোট পার্কে ঢুকল। বেঞ্চে লোকজন বসে আছে, কয়েকটা বাচ্চা ফুটবল খেলছে। কেউ আবার নদীর ধারে বসে পিকনিক করছে। দীপু চারপাশের দৃশ্য দেখে বলল, “এখানে এত কিছু করার আছে! অথচ আমাদের গঙ্গার ধারের মতোই একটা অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে আছে!”

খাবার আর আড্ডা

তারা ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকল এক ছোট্ট, আরামদায়ক বেকারিতে। দোকানের ভেতর ঢুকতেই দীপু মিষ্টি গন্ধে মুগ্ধ হয়ে বলল, “এই গন্ধটা কী?” অলিভার মুচকি হেসে বলল, “এটা আমাদের স্কোনস আর ক্রস্যান্ট। এগুলো আমরা চা বা কফির সঙ্গে খাই। তুমি চা পছন্দ করো তো?” দীপু মাথা নাড়ল। সে ভাবল, “দার্জিলিং চা নিয়ে আমাদের কত গল্প আছে!” তারা একটা স্কোন ভাগ করে খেল। অলিভার স্কোনে মাখন আর জ্যাম লাগিয়ে দীপুকে দিল। দীপু এক কামড় খেয়ে বলল, “এটা মুর্শিদাবাদের মিষ্টির মতো নয়, কিন্তু খেতে দারুণ মজা!” অলিভার বলল, “তোমাদের মিষ্টির কথা শুনেছি। লন্ডনে অনেক ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে, যেখানে তোমাদের মিষ্টি পাওয়া যায়।”

দীপু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট এখানে এত আছে? কেন?” অলিভার জানাল, “লন্ডন হলো একটা মেল্টিং পট। বিভিন্ন দেশের লোক এখানে থাকে। ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ অনেক বছর আগে এখানে এসেছে। ব্রিক লেন বলে একটা জায়গা আছে, যেখানে প্রচুর বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আর দোকান। আর জানো, দুর্গাপুজোর মতো উৎসবও এখানে পালিত হয়।” দীপু চোখ বড় করে বলল, “সত্যি? আমাদের পুজো এখানে হয়?” অলিভার মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আর জানো, বাংলাও ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রচলিত ভাষাগুলোর একটা। এখানে প্রচুর বাংলাদেশি মানুষ থাকেন। তোমার মতো অনেক বাচ্চাও আছে।” দীপু গর্বে বলল, “তাহলে তো লন্ডনে অনেক কিছুই আমাদের দেশের!”

অলিভার যোগ করল, “আর ব্রিটিশরা তোমাদের দেশের দার্জিলিং চা নিয়ে পাগল। ওটা খুব বিখ্যাত। তবে জানো, চা চাষের গল্পটা কীভাবে শুরু হয়েছিল? ব্রিটিশরা চীন থেকে চা আনার পর ভারতের অসম আর দার্জিলিংয়ে চাষ শুরু করেছিল। এখন তো দার্জিলিং চা সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত!” দীপু গম্ভীরভাবে বলল, “তাহলে ওরাই আমাদের দেশের চা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এটা তো এখন আমাদের গর্ব!” তারা চা আর স্কোন খেতে খেতে আরও গল্প করল। দীপু খেয়াল করল, বেকারির ভেতরে অনেক রকমের মানুষ বসে আছে। কেউ কালো, কেউ সাদা, কেউ আবার একেবারে চাইনিজদের মতো।

দীপু বলল, “এখানে সবাই দেখতে এত আলাদা! সবাই কোথা থেকে এসেছে?” অলিভার বলল, “লন্ডন এমন একটা শহর, যেখানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষ একসঙ্গে থাকে। এখানে তুমি চাইনিজ, আফ্রিকান, ইন্ডিয়ান, আরবের মতো সব রকমমানুষ পাবে। সবাই একসঙ্গে থাকে, কাজ করে, আর আনন্দ করে। এখানে সবাই নিজের মতো করে মিশে যায়।” দীপু চারপাশে তাকিয়ে বলল, “এখানে তো সবাই আলাদা-আলাদা দেশের। তা হলে, সবাই একসঙ্গে কীভাবে থাকে?” অলিভার হেসে বলল, “কেন থাকবে না? আমরা সবাই অনেক বিষয়ে একমত হই। খাবার, উৎসব আর খেলার মধ্যে মিল থেকেই এই একতা তৈরি হয়। তুমি জানো, এখানে ফুটবল কত বড় বিষয়?”

দীপু অবাক হয়ে বলল, “ফুটবল? সবাই ফুটবল দেখে?” অলিভার মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ! এটা লন্ডনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আর্সেনাল, চেলসি, টটেনহ্যাম-এর মতো বড় বড় ক্লাব আছে। স্টেডিয়ামগুলো সব সময় ভরা থাকে।” দীপু উত্তেজিত হয়ে বলল, “সত্যি? আমি ফুটবল খুব পছন্দ করি। দাদা আর আমি স্কুলে খেলি!” অলিভার বলল, “তাহলে ঠিক করে রাখি। পরের বার দেখা হলে আমরা একসঙ্গে একটা ম্যাচ দেখতে যাব। আর জানো, লন্ডনে শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেটও খুব জনপ্রিয়। লর্ডস তো ক্রিকেটের মন্দিরের মতো। অনেক বড় ম্যাচ হয় সেখানে।” দীপু চমকে উঠে বলল, “লর্ডস! সেটা তো আমি টিভিতে দেখেছি। তুমিও ক্রিকেট খেলো?” অলিভার বলল, “খেলি, তবে তোমাদের মতো ক্রিকেট নিয়ে আমরা এত পাগল নই। ফুটবল এখানে বড় ব্যাপার। কিন্তু তোমাদের ইন্ডিয়ান টিম লর্ডসে খেললে স্টেডিয়াম ভর্তি হয়ে যায়। সবাই তোমাদের বিরাট কোহলির মতো খেলোয়াড়দের দেখার জন্য ভিড় করে।”

তারা বেকারি থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। দীপু এখনও ভাবছিল, কত রকমের মানুষ আর সংস্কৃতি লন্ডনে মিশে আছে। অলিভার তাকে লন্ডনের আরেকটি বিখ্যাত খাবার খাওয়ানোর প্রস্তাব দিল। অলিভার আর দীপু হাঁটতে হাঁটতে এক ছোট্ট খাবারের দোকানে ঢুকল, যেখানে লেখা ছিল, “বেস্ট ফিশ অ্যান্ড চিপস ইন লন্ডন!” দোকানের ভেতর থেকে গরম ভাজার গন্ধ ভেসে আসছিল। দীপু ঘ্রাণ শুঁকেই বলল, “এটা দারুণ গন্ধ! আমরা এখানেই খাবো?” অলিভার বলল, “হ্যাঁ, এখানে ফিশ অ্যান্ড চিপস খুব ভালো হয়। তুমি এটা পছন্দ করবে।”

তারা টেবিলে বসতেই একজন ওয়েটার বড় কাগজের ট্রেতে করে তাদের জন্য খাবার নিয়ে এল। ট্রেতে ছিল গরম ভাজা মাছের টুকরো আর মোটা করে কাটা আলুর চিপস। পাশে এক ছোট্ট কাপে ছিল ভিনিগার আর টমেটো সস। দীপু গরম ধোঁয়া ওঠা মাছের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা দেখতে তো আমাদের ফিশ ফ্রাই-এর মতো!” অলিভার বলল, “তাহলে খেয়ে দেখো, এটা কেমন লাগে!” দীপু কাঁটাচামচ দিয়ে গরম ভাজা মাছের একটা টুকরো তুলল। প্রথমে একটু ঠান্ডা করে মুখে দিল। সে প্রথমেই বুঝতে পারল, বাইরের প্রলেপটা খুব মচমচে, আর ভেতরের মাছটা নরম আর রসালো।

“এটা দারুণ!” দীপু চমকে বলল। “এটা আমাদের ফিশ ফ্রাই-এর মতো, কিন্তু একটু আলাদা। আমাদের ফিশ ফ্রাই-তে মশলা বেশি থাকে। এটাতে তো একেবারে মশলা নেই!” অলিভার বলল, “আমাদের খাবার মশলাদার হয় না। তবে ভিনিগার আর সস দিয়ে খেলে স্বাদটা ভালো লাগবে।” দীপু সস আর ভিনিগার দিয়ে আরেকটা কামড় খেল। তারপর আলুর চিপস তুলে মুখে দিল। খেতে খেতে সে বলল, “এটা তো আমাদের ফিশ ফিঙ্গারস-এর মতো! আর ফিশ চপস-এর বাইরের পরতটা এর মতো মচমচে। ফিশ কবিরাজি-র কথা মনে পড়ছে!” অলিভার অবাক হয়ে বলল, “ফিশ কবিরাজি? সেটা কী?” দীপু হাসতে হাসতে বোঝাল, “এটা আমাদের বাংলার একটা দারুণ খাবার। মাছের ভেতরে ডিম আর মশলা মেখে মচমচে করে ভাজা হয়। খুব মজার!” অলিভার মাথা নেড়ে বলল, “তাহলে তোমাদের খাবারগুলো শুনতে দারুণ লাগছে। লন্ডনে অনেক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে, কিন্তু ফিশ কবিরাজি আমার খাওয়া হয়নি। একদিন তোমার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে এটা খাবো!”

দীপু মুচকি হেসে বলল, “তাহলে তোমার কলকাতায় আসতেই হবে। আমি তোমাকে ফিশ কবিরাজি খাওয়াবো। আর তোমাকে আমাদের রাস্তার খাবার গোলগাপ্পা আর ঝালমুড়ি খেতেও দেবো। সেগুলোও খুব মজার।” তারা খেতে খেতে গল্প করতে লাগল। দীপু খেয়াল করল, দোকানে বসে থাকা অন্য মানুষরাও ফিশ অ্যান্ড চিপস খাচ্ছে। সবার খাবার পরিবেশনে একই রকমের কাগজের ট্রে আর গরম ভাজার গন্ধে ভরা দোকানটা একেবারে ব্যস্ত। খাওয়া শেষ করে দীপু খুশি মনে বলল, “ফিশ অ্যান্ড চিপস খুব মজার! তবে এটা আমাদের মতো মশলাদার নয়। কিন্তু ভীষণ ভালো লেগেছে। এটা আমি বাড়ি ফিরে সবাইকে বলব।”

লন্ডনের আই আর হাইড পার্ক

ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়ে দীপু আর অলিভার হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাল লন্ডন আই-এর কাছে। বিশাল চাকার মতো দেখতে এই জায়ান্ট হুইল দেখে দীপু থমকে দাঁড়াল। তার মাথার ওপর দিয়ে একটার পর একটা কেবিন ধীরে ধীরে উঠছে আর নামছে। দীপু অবাক হয়ে বলল, “এটা এত বড় কেন? এটা কি সত্যি ঘোরে?” অলিভার হেসে বলল, “হ্যাঁ, এটা ঘোরে। এর মধ্যে বসে পুরো লন্ডন শহর দেখতে পারবে। টেমস নদী, ব্রিজ, আর শহরের বিখ্যাত সব জায়গা — সবকিছু এখান থেকে দেখা যায়। এটাতে উঠলে তুমি লন্ডনকে পুরো নতুনভাবে দেখতে পাবে।” দীপু অবাক হয়ে বলল, “এটা তো আমাদের মেলার নাগরদোলার মতো! কিন্তু নাগরদোলা এত বড় হয় না। এটা তো আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে!” অলিভার হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ, এটা অনেক বড়। এর একবার পুরো ঘুরে আসতে আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগে।”

তারা একটি কাচের কেবিনে উঠল। ধীরে ধীরে চাকা ঘুরতে শুরু করল। যত উপরে উঠতে লাগল, তত দীপু আশেপাশের লন্ডনের দৃশ্যগুলো দেখতে পেল। টেমস নদী তাদের ঠিক নিচে, ব্রিজগুলোর ওপর দিয়ে গাড়ি চলছে। দূরে বিগ বেন, টাওয়ার ব্রিজ, আর শার্ড-এর উঁচু মাথা আকাশ ছুঁচ্ছে। দীপু জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবল, “মেলার নাগরদোলায় তো কেবল মাঠ দেখা যায়। কিন্তু এখানে আকাশ থেকে পুরো শহর দেখা যাচ্ছে। এটা সত্যিই একেবারে অন্যরকম!”

লন্ডন আই থেকে নামার পর অলিভার বলল, “এবার চল, তোমাকে লন্ডনের সবচেয়ে বিখ্যাত পার্কে নিয়ে যাই। আমি নিশ্চিত, তোমার ভালো লাগবে।” তারা গেল হাইড পার্ক-এ। দীপু গেটের ভেতর ঢুকতেই বড় বড় গাছ, সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ আর লম্বা রাস্তা দেখে থমকে দাঁড়াল। দূরে ছোট্ট একটা লেক, হাঁস-রাজহাঁস ভাসছে। দীপু বলল, “এটা কি সত্যি একটা পার্ক? এটা তো আমাদের ময়দানের থেকেও অনেক বড়!” অলিভার বলল, “এটা লন্ডনের ঐতিহ্য। এখানে মানুষ প্রাতঃভ্রমণ, পিকনিক, এমনকি কনসার্ট পর্যন্ত করে। এই হাইড পার্ক লন্ডনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্ক।” তারা পার্কের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে একটা বেঞ্চে বসল। দূরে কিছু মানুষ ফুটবল খেলছে, কেউ লেকের ধারে বসে বই পড়ছে। দীপু হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “এগুলো এত সুন্দর! কেউ কি এগুলোকে ধরে নিয়ে যায় না?” অলিভার হেসে বলল, “না। এখানে সবাই জানে, এগুলো হাইড পার্ক-এর অংশ। কেউ এগুলোকে বিরক্ত করে না।”

দীপু লেকের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মনে করল, বহরমপুরের জুবলি লেকের কথা। সেখানে সেও দাদার সঙ্গে বসে হাঁস-রাজহাঁস দেখত। তবে সেই লেকের আশেপাশে লোকজন চা-নাস্তার দোকানে ভিড় করত। দীপু ভাবল, “জুবলি লেক আমাদের মতো ব্যস্ত, কিন্তু এখানকার লেকটা যেন অন্যরকম। এত পরিষ্কার আর শান্ত!” দীপু চুপ করে বসে চারপাশটা দেখতে লাগল। একটা বড় বটগাছের নিচে কয়েকজন পিকনিক করছে। মাঠের অন্যদিকে ছোট্ট একটা কাফে থেকে চায়ের ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবকিছু এত সাজানো দেখে দীপু বলল, “এটা যেন একদম মনের মতো জায়গা।” অলিভার মাথা নেড়ে বলল, “তুমি জানো, হাইড পার্ক শুধু ঘোরার জায়গা নয়। এখানে স্পিকারের কর্নার বলে একটা জায়গা আছে, যেখানে মানুষ এসে নিজের কথা বলতে পারে। স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য এটা বিখ্যাত।” দীপু অবাক হয়ে বলল, “আমাদের দেশে যদি এমন জায়গা থাকত, কত ভালো হতো!”

তারা আবার হাঁটতে লাগল। দীপু ভাবছিল, আজ সারাদিন যেন ভূগোল বইয়ের পাতা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। টেমস নদী, বিগ বেন, লন্ডন আই — সবকিছু যেন চোখের সামনে গল্প বলে যাচ্ছে। সে ঠিক করল, বাড়ি ফিরে এই গল্পগুলো তার বন্ধুদের বলবে। সে তাদের বলবে, “পড়াশোনা আর কল্পনা জীবনের দরজা খুলে দিতে পারে। তোমরাও একদিন অনেক দূরের জায়গায় যেতে পারবে!” অলিভার দীপুকে বলল, “তোমার কী মনে হয়, লন্ডনের কোন জায়গাটা তোমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে?” দীপু মুচকি হেসে বলল, “সবই ভালো লেগেছে। কিন্তু হাইড পার্ক-এর হাঁস আর লেক অদ্ভুত সুন্দর।”

স্বপ্নের ঘোর থেকে বাস্তব

সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় দীপু নদীর ধারে বসে বলল, “আমি এখান থেকে যেতে চাই না। আবার আসব।” হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে দীপুকে জাগিয়ে দিল। সে চমকে উঠল। দেখল, সে তার নিজের ঘরে। ভূগোল বইয়ের ইউকে অধ্যায় খোলা। সে মুচকি হেসে ভাবল, “এটা স্বপ্ন ছিল, কিন্তু একদিন আমি সত্যি লন্ডনে যাব।” দীপু মাকে ডেকে বলল, “মা, আমি বড় হয়ে পুরো পৃথিবীটা দেখতে চাই!” মা হেসে বললেন, “তাহলে এখন থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করো। স্বপ্ন পূরণ করতে হলে পরিশ্রম করতে হবে।” দীপু ঠিক করল, তার স্বপ্নগুলো একদিন সত্যি করবে। লন্ডনের স্কাইলাইন আরেকবার দীপুর চোখে ভেসে উঠল…

আপনাদের দীপুর ভ্রমণ অ্যাডভেঞ্চার কেমন লাগল? কী ভাবছেন, দীপু এবার পরের গল্পে অতীত অথবা বর্তমানে কোথায় যেতে পারে? আপনার মতামত বা প্রশ্ন জানালে ভালো লাগবে। আরো আলোচনা করতে চাইলে LinkedIn বা Medium-এ যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন!

#দীপুরভ্রমণকাহিনি #দীপুরডায়েরি #ভ্রমণগল্প #ভ্রমণকাহিনি #কৌতূহল #বিশ্বভ্রমণ #ভারত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top

Share Your Thoughts with Us

Meet our Quantum Travelers: Alice, an ace soccer player who understands the world through motion and action, and Bob, a scientist excited to step out of theory and experience quantum physics firsthand! Together, they journey into the strange world of Quantum Physics and find out.

Your Testimonial is Valuable to Us

Meet our Quantum Travelers: Alice, an ace soccer player who understands the world through motion and action, and Bob, a scientist excited to step out of theory and experience quantum physics firsthand! Together, they journey into the strange world of Quantum Physics and find out